কোকিল কণ্ঠে মাতিয়ে রেখেছেন দেশবাসীকে। সুরের যাদু পেরিয়ে গিয়েছে সীমানাও। তিনি হয়েছেন সুর সম্রাজ্ঞী। প্রজন্মের পর প্রজন্ম তাঁর গানেই হয়েছে বুঁদ। তাঁর সুরে মাতিয়ে রেখেছেন সঙ্গীত প্রেমীদের। না ফেরার দেশে হারিয়ে গিয়েও রয়ে গিয়েছেন মনে... তিনি লতা মঙ্গেশকর । রেখে গেছেন তাঁর অনবদ্য সৃষ্টি এবং লক্ষ লক্ষ অনুরাগীকে। ৯৪তম জন্মবার্ষিকীতে শ্রদ্ধার্ঘ।
সুর সম্রাজ্ঞীকে শ্রদ্ধার্ঘ: ১৯২৯ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর মধ্যপ্রদেশের ইন্দৌরে জন্ম হয় লতা মঙ্গেশকরের। তাঁর বাবা দীনানাথ মঙ্গেশকর ছিলেন খ্যাতনামা মরাঠী, কোঙ্কনী সঙ্গীতশিল্পী এবং নাট্যশিল্পী। মাত্র ৫ বছর বয়সে বাবার কাছেই গানের তালিম শুরু হয় ছোট্ট লতার। ১৯৪১ সালের ১৬ ডিসেম্বর গায়িকা হিসেবে পথ চলা শুরু হয় লতা মঙ্গেশকরের। ৩৬টিরও বেশি ভাষায় ৩০ হাজারের বেশি গান গেয়েছেন লতা মঙ্গেশকর। একের পর এক সাফল্যের সোপান তিনি পেরিয়ে গিয়েছেন অবলীলায়। হয়ে উঠেছেন ভারতের নাইটিঙ্গল। প্রজন্মের পর প্রজন্ম বড় হয়েছে তাঁর গান শুনে।
পথচলার শুরু: জন্মসূত্রে তাঁর নাম ছিল হেমা। বাবা পণ্ডিত দীননাথ মঙ্গেশকরের একটি নাটকে চরিত্র বেশ জনপ্রিয় হয় সেসময়। বাবার ‘ভাব বন্ধন’ নাটকের ‘লতিকা’র চরিত্রে প্রভাবিত হয়ে হেমার নাম বদল করে রাখা হয় লতা। ১৯৪২ সালে প্রথমবার মারাঠী ছবির জন্য গান গেয়েছিলেন। কিন্তু ছবির চূড়ান্ত সম্পাদনা পর্বে সেই গান বাদ দিয়ে দেওয়া হয়। ১৯৩৮ সালে মাত্র ৯ বছর বয়সে শোলাপুরের নূতান থিয়েটারে প্রথম স্টেজ পারফর্মেন্স তাঁর। ১৯৪৯ সালে মহল সিনেমায় গানের হাত ধরেই তাঁর কেরিয়ারে মোড় ঘুরে গিয়েছিল। 'আয়েগা আনেওয়ালা' গানের মাধ্যমে পেয়েছিলেন খ্যাতির স্বাদ। তবে ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি প্রথমেই তাঁকে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানিয়েছিল এমনটা নয়। বরং তাঁর কণ্ঠস্বরের জন্য একাধিকবার হাত ছাড়া হয়েছে কাজ। একবার এক সাক্ষাৎকারে প্রয়াত সঙ্গীতশিল্পী জানিয়েছিলেন, নিজের গান তিনি কখনই শুনতেন না।
তবে সঙ্গীতশিল্পীর পাশাপাশি তাঁর আরও একটা পরিচয় আছে। নাইটঙ্গল ছিলেন সুরকারও। একাধিক মারাঠী এবং বাংলা গানে সুর দিয়েছেন। ১৯৫৫ সালে রাম রাম পাভহানে ছবিতে সুর দিয়েছিলেন তিনি। কিশোর কুমারের কণ্ঠে বাংলা আধুনিক গানেও সুর দেন সুর সম্রাজ্ঞী। ‘তারে আমি চোখে দেখিনি’ গানে সুর দেন লতা মঙ্গেশকর।
১৯৬২ সালের ইন্দো-চিন যুদ্ধের পর দেশ তখন কার্যত বিধ্বস্ত। তাবড় শিল্পীদের একছাতার নীচে নিয়ে ত্রাণ সংগ্রহের চেষ্টা চলছে সর্বত্র। ১৯৬৩ সালে তেমনই দিল্লির রামলীলা ময়দানে আয়োজিত তেমনই এক অনুষ্ঠানে গাওয়ার আমন্ত্রণ পান লতা, যেখানে ২৭ জানুয়ারি বলিউডের তরফে যুদ্ধে শহিদ জওয়ানদের স্ত্রী-পরিবারের জন্য ত্রাণ সংগ্রহের আয়োজন হয়েছিল। সেখানে তাঁর কণ্ঠে ‘অ্যায় মেরে ওয়াতন কে লোগোঁ’ শুনে চোখের জল ধরে রাখতে পারেননি তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জহরলাল নেহেরু। ভারতীয় শিল্পীদের মধ্যেই তিনিই প্রথম ঐতিহ্যবাহী রয়াল অ্যালবার্ট হলে সঙ্গীত পরিবেশন করেছিলেন। আন্তর্জাতিক মঞ্চে সেটাই ছিল তাঁর প্রথম উপস্থাপনা। ওই একই সালে গিনিস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডে জায়গা করে নিয়েছিলেন তিনি। সেই সময়ের হিসেবে ২৫ হাজার গান গেয়েছিলেন তিনি।
তবে গানের পাশাপাশি ক্রিকেট নিয়ে আগ্রহ ছিল তাঁর প্রবল। ১৯৮৩ সালে ভারতের প্রথম ক্রিকেট বিশ্বকাপ জয়ের সাক্ষী থেকেছেন তিনি। ভারতীয় দলের পাশে দাঁড়াতে অর্থ সংগ্রহের জন্য একটি বিনামূল্যে কনসার্টের আয়োজন করেছিলেন। সাক্ষী থেকেছেন ২০১১ সালের ক্রিকেট বিশ্বকাপেরও। সাংসদ পদের দায়িত্ব সামলেছেন তিনি। ১৯৯৯ সালে রাজ্যসভার সাংসদ হিসেবে মনোনীত হন লতা। ভারতীয় সেনাকে শ্রদ্ধা জানিয়ে শেষ গান রেকর্ড করেছিলেন তিনি। ২০১৯ সালে ৩০ মার্চ রিলিজ করে তাঁর গাওয়া শেষ গান ‘সুগন্ধ মুঝে ইস মিট্টি কি।’ ভারতীয় সঙ্গীত জগতে তাঁর অবদানের জন্য পেয়েছেন সর্বোচ্চ সম্মান- "ভারতরত্ন" (Bharat Ratna), "দাদা সাহেব ফালকে (Dada Saheb Phalke)" পুরস্কার।