রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং আলবার্ট আইনস্টাইন বিংশ শতাব্দীর দুই জিনিয়াস। এই দুই বিস্ময়-প্রতিভার প্রথম সাক্ষাৎ(১৪ই সেপ্টেম্বর, ১৯২৬) সকলের কৌতুহলের বিষয়। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের প্রতিনিধিস্বরূপ দুই মনীষীর মোলাকাতজনিত মত-বিনিময়, যা কি না ৯৬ বছর আগের ঘটনা, তা আজও যে-কোনও চিন্তাশীল মনের খাদ্য। এখনও তা উঠে আসে আলোচনায়। নানা প্রসঙ্গে বারবার।
কী কী বিষয়ে আলোচনা করেছিলেন দুজনে? এক কথায় গূঢ়, কূট নানা প্রশ্নে আবর্তিত হয়েছিল ওঁদের বার বারের কথালাপ। প্রাথমিক পরিচয়ে দুজনে কবি ও বিজ্ঞানী হতে পারেন, কিন্তু মূলত ওঁরা দার্শনিক। ওঁদের খোঁজ রীতিমত গভীরে। জার্মান যুব আন্দোলনের উত্স সন্ধান, প্রযুক্তির অগ্রগতি মানবজীবনে আশীর্বাদ না অভিশাপ, প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য সঙ্গীত ও চিত্রশিল্পে শব্দ সুর সঙ্গতি রেখা ও রঙের ভূমিকা - এ রকম সব প্রশ্নে ওঁরা চিন্তিত। তবে, যে বিষয়ে ওঁদের তর্ক এগিয়েছিল বহু দূর, যে বিষয়টা গত ৯৬ বছরে ভাষ্যকারদের নজর কেড়েছে প্রভূত পরিমাণে, তা হল সত্যের স্বরূপ। এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে বাস্তব অবস্থা। তা কি মানুষের চেতনা-নিরপেক্ষ হিসেবে বিরাজমান? না কি সেই বাস্তবতা ওই চেতনারই নির্মাণ মাত্র?
কথালাপে সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছিল ভাষা। 'মাই মেমরিজ অব আইনস্টাইন' প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, 'ইংরেজি ভাষায় তাঁর দখল কথাবার্তা চালিয়ে যাওয়ার পক্ষে যথেষ্ট নয়, আর আমি জার্মান ভাষা জানি না। দোভাষীর পক্ষে কাজটা মোটেই সহজ ছিল না।' এ কারণে কারও কারও মতে, আইনস্টাইন-রবীন্দ্রনাথ আলাপ যেন দুই গ্রহের কথোপকথন। কেউ কারও বক্তব্য বোঝেননি।
তবু ওঁদের বাক্য-বিনিময় আকর্ষণীয়। দুটি কারণে। কথাবার্তায় ওঁরা দাঁড়িয়ে নিজ নিজ মেরুতে। যেন ঘোষণা করছেন জাতি-ধর্ম। কবির দাবি, সত্য চেতনা-নিরপেক্ষ নয়। তা মানুষের নির্মাণ। এ ছাড়া আর কী-ই বা বলতে পারেন কবি? তিনি যে স্রষ্টা। শব্দে-শব্দে নির্মাণ করেন সত্য। আর বিজ্ঞানী? অন্তত আইনস্টাইন মনে করেন, তিনি স্রষ্টা বই কিছু নন। নিজস্ব গুণাবলি নিয়ে বিশ্বব্রহ্মাণ্ড আপনি বিরাজমান। গবেষকের কাজ সে সব গুণের সন্ধান। হায়, আইনস্টাইনের এই বিশ্বাস যে ভ্রান্ত প্রমাণ করেছে বিজ্ঞানের নতুন শাখা কোয়ান্টাম মেকানিক্স। তা যে বলে দিয়েছে, দৃশ্য থেকে দর্শক আলাদা নয়। দর্শক শনাক্ত না করলে দৃশ্য অবাস্তব। এ হেন বক্তব্য যে গ্রহনযোগ্য মনে হয়নি আইনস্টাইনের, তা বলাই বাহুল্য। কবি আর বিজ্ঞানীর তর্কের দ্বিতীয় আকর্ষণ ঠিক এইখানে। কবির বীণায় যেন কোয়ান্টামের সুর।
Tags:
News